
জোহানেসবার্গ জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদির ঐতিহাসিক ভাষণ, বৈশ্বিক মঞ্চে 'গ্লোবাল সাউথ'-এর কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি হলো। এদিনও তিনি তার বক্তব্যে ভারতীয় পরম্পরা এবং ঐতিহ্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরলেন এবং এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ'-এর ভাবধারাকে এক নতুন মাত্রা দিলেন মঞ্চে।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত জি-২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতের পক্ষ থেকে এক ঐতিহাসিক ও দূরদর্শী ভাষণ দিয়েছেন। এই সম্মেলনটি আফ্রিকার মাটিতে প্রথম জি-২০ আয়োজন এবং গ্লোবাল সাউথের দেশগুলির মধ্যে (ইন্দোনেশিয়া, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা) টানা চতুর্থ বছর সভাপতিত্বের ধারা বজায় রাখার কারণে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। মোদী তাঁর ভাষণে বারবার 'বসুধৈব কুটুম্বকম' বা 'এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ'-এর ভারতীয় দর্শনকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরেন এবং বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষায় ভারতকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী মোদী জি-২০-এর প্রথম অধিবেশন 'অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি'তে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি এমন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যখন ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বৈত আঘাত উন্নয়নশীল, বিশেষ করে নিম্ন-আয়ের দেশগুলির মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে।
তিনি জোর দেন যে, শুধু জি-২০ সদস্য দেশগুলোর সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির সমন্বয় করলেই চলবে না, বরং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের মতো বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কার প্রয়োজন, যাতে তারা উন্নয়নশীল দেশগুলির ঋণ সংকট মোকাবিলায় আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। মোদী তাঁর বক্তৃতায় ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য টেকসই সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং ঋণের বোঝা কমাতে জি-২০-কে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি উল্লেখ করেন, বৈশ্বিক আর্থিক সুশাসনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
স্থিতিস্থাপক বিশ্ব এবং ন্যায়সঙ্গত শক্তি রূপান্তর
দ্বিতীয় অধিবেশন 'একটি স্থিতিস্থাপক বিশ্ব – জি-২০-এর অবদান'-এ প্রধানমন্ত্রী মোদী জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস নিয়ে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় ন্যায়সঙ্গত শক্তি রূপান্তর প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলির উচিত তাদের জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা, যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলি ফসিল ফুয়েল থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরের কঠিন কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে।
ভারতের সাফল্য তুলে ধরে তিনি দুর্যোগ মোকাবিলায় ঝুঁকি হ্রাস করার ক্ষেত্রে জি-২০-এর আরও সক্রিয় ভূমিকার ওপর জোর দেন। খাদ্য ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর প্রস্তাবও দেন তিনি। তাঁর মতে, স্থিতিস্থাপকতা তখনই আসবে যখন আমরা কেবল নিজেদের শক্তি নয়, বরং সামগ্রিক পৃথিবীর সুরক্ষা নিশ্চিত করব।
তৃতীয় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন 'সকলের জন্য একটি ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যৎ'-এ প্রধানমন্ত্রী মোদী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। গুরুত্বপূর্ণ খনিজ এবং ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের মতো বিষয়গুলিতে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, এআই প্রযুক্তি মানবজাতির জন্য এক বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে, কিন্তু এর ব্যবহার যেন দায়িত্বশীল ও নৈতিক হয়, তা নিশ্চিত করতে একটি বৈশ্বিক কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। ভারতের ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার , যেমন ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস এবং আধার-এর মতো ব্যবস্থাগুলিকে তিনি বিশ্বের সামনে একটি মডেল হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর মতে, এই ডিজিটাল মডেলগুলি অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং সুশাসন নিশ্চিত করে বৈষম্য দূর করতে পারে।
তিনি গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলির স্থিতিশীল সরবরাহ এবং এই খনিজগুলির ওপর নির্ভর করে থাকা সবুজ প্রযুক্তিগুলির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপরও জোর দেন। এছাড়া, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে 'শালীন কাজ' নিশ্চিত করার জন্য জি-২০ দেশগুলিকে যৌথভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাষণের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থকে চ্যাম্পিয়ন করা। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে ২০২৩ সালে ভারতের সভাপতিত্বের সময়েই আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি-২০-এর স্থায়ী সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এটি কেবল একটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ নয়, বরং বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আফ্রিকার এক-পঞ্চমাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভারতের গভীর অঙ্গীকারের প্রতীক।
তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্সির থিম 'ঐক্য, সমতা এবং স্থায়িত্ব' এর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বলেন, এই থিম গত বছরের নিউ দিল্লি এবং আগামী বছরের ব্রাজিলের প্রেসিডেন্সির ফলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
জি-২০ সম্মেলনের পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী মোদী অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের সঙ্গে সফল দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন এবং ভারত-ব্রাজিল-দক্ষিণ আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনেও অংশ নেন। এই বহুমাত্রিক উপস্থিতি স্পষ্ট করে দেয় যে, ভারত কেবল জি-২০-এর মঞ্চে নয়, অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামেও সহযোগিতামূলক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। জোহানেসবার্গের এই সম্মেলন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারতের নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে এমনটা দাবি করলেন বিশেষজ্ঞরাও।
জোহানেসবার্গ জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদির ঐতিহাসিক ভাষণ।এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ, জি-টুয়েন্টি বৈঠকে মোদির স্লোগান।